Wednesday, 29 March 2017

বৃহন্নলা

মিত্তির বাড়ি আজ বহুবছর পর আলোর রোসনাই।হ্যা কারন আজ ওদের একমাত্র বংশধর
রোহনের অন্নপ্রাশন।
খুব ঘটা করেছেন মিত্তির গিন্নী।
স্বামীকে বলেই দিয়েছেন এ ব্যাপারে তার কোন মন্তব্য চলবে না।রেবা তার মনোমতো 'সবরকম
আয়োজন করবে কোন ত্রুটি রাখবে না।
তাই মন ভরে খরচা করেছেন মিত্তির গিন্নী রেবা।
এসব আনন্দের মাঝেও কোথায় যেনো একটা গোপন ব্যাথা কাঁটার মতো খচখচ
করে ।
কত যুগ হয়ে গেছে তবুও যেনো সেদিন টা চোখের সামনে এসে সব আনন্দে একঠা কালো ছায়া
হয়ে অদৃশ্য পর্দা হয়ে ঝুলতে থাকে।
কিছুতেই ভুলতে চেয়েও যেনো ভুলতে দেয় না ।
আর এই তো কদিন আগেই যেনো তা আবার নতুন ভাবে উন্মোচিত হলো।
হ্যা, যেদিন হাসপাতাল থেকে খবর টা এলো যে বিমলের ছেলে হয়েছ।
খুশীতে আত্মহারা হয়ে গেছিলো রেবা আর সনাতন।
সত্যি তারা যেনো হাল ছেড়ে দিয়েছিলো ,এই দশ বছরেও যখন বিমলের স্ত্রীর কোলে কেউ এলো না।
তারা ভেবেই নিয়েছিলো এ তাদের পূর্বকৃত পাপের ফল।
তাই এতদিন বাদে বিমলের স্ত্রীর অন্তস্বতা হওয়ার খবর টা পেয়ে প্রতিপদে আশংকায় থেকেছেন
শেষ রক্ষার জন্য।
তাই যেদিন বাড়ি আনা হলো শিশুকে সেদিন থেকেই সব যত্নের দায়িত্ব রেবা তুলে নিলো
নিজের কাঁধে।
এভাবেই কবেই যেনো দু মাসে পা রাখলো রোহন।

রেবার মনেই নেই দিন কিভাবে কেটে যাচ্ছে।
বাড়ির নীচে সেদিন ঢাক ঢোলের আওয়াজে বারান্দা থেকে উঁকি মেরে দেখে রেবা বৃহন্নলার দল
এসেছে।
তার নাতিকে আশীর্বাদ দিতে।
তিনি হ়াঁক পারেন কাজের মেয়ে মালতীকে, হুকুম দেন অঢেল চাল ,ডাল তেল চিনি
মিষ্টি সাজিয়ে নীচে আসতে।
তিনি নিজেও কোলে করে বাচ্চাটিকে নিয়ে নেমে আসেন।
বৃহন্নলার দল অনেক নাচ গান করে হৈ চৈ ফেলে দেয় ।
তারা কিছু দাবি করার আগেই রেবা মালতীকে বলেন তাদের জিনিস গুলো দিয়ে দতে।
ওরা তো খুব খুশী ।এছাড়াও কিছু শাড়ি, টাকা আর সামান্য সোনাও দেন।
তার খালি একটাই অনুরোধ এই দলটি যেনো মনে কোন অপূর্নতা নিয়ে না যায় ,তার
এতোদিনের এতো সাধের নাতি যেনো সুস্থ ও দীর্ঘায়ু হয়।
অনেক আদর আশীর্বাদের পর ঐ দলটি চলে যায় কিন্তু মালতি গজগজ করতেই
থাকে
সে বলে---এ তোমার বাড়াবাড়ি মা জননী।পঁচিশ হাজার টাকা অতো খাবার দাবার
এতো কিছুর কি দরকার ছিলো।
---তোকে এসব বুঝতে হবে না ,তুই নিজের কাজে যা।এ আমার প্রথম বংশধর
ওর সব সুরক্ষা চাই।
এতো কিছু দেওয়া হয়েছে বলে বিমলের বৌ ও একটু রাগারাগি করে তবে সে
মনে মনে খুশীই হয় এই ভেবে যে তার রোহন ঠাকুমার খুব কাছের জন হয়ে উঠবে

আজ এই উৎসবের দিনে ঐ দিনটা বড় বেশী মনে পড়ছে রেবার।
ওরা ঐদিন চলে যাবার পর আবার সেই ভাবনাটা তাকে আস্ত গিলে খেতে এলো।
রোহনের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট ভুলতে চান রেবা।
তার অনেকদিনের পুরোন পাপের জন্য এতবছর তার আঙিনা শূন্য ছিলো।
ওদের নখচগান হয়ে চলে যাবার আরো দিন পনেরো পর একদিন দুপুরে
রেবা যখন বসে আছে নিজের ঘরের চেয়ার টাতে,হঠাৎ আবার বাইরে তালির
আওয়াজ।
সচকিত হয়ে উঠে রেবা।
মালতী ছুটে এসে বলে
---মা, ওনারা তো আবার এয়েছেন ,তবে এবার একা।মনে হয় বেশী দাও মারবেন।
তখনি বলেছি যে এতো পেশয় দিয়ো না ,তা শুনলে আমার কথা।যাও দেখো কি চায়।
---বাজে না বকে ওকে উপরে নিয়ে আয়।
---ওপরে আনবো ?কি বলো গো তুমি ।
---যা বলছি তাই কর।
রেবার হুকুমে নীচে গিয়ে ডেকে আনে মালতী ঐ মানুষটিক।
উপরে আসার পর ইশারায় মালতীকে চলে যেতে বলে রেবা । তারপর আগুন্তুকের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে
তাকায় রেবা।
মানুষটি রেবাকে অনুরোধ করে ঘরের দরজা টা বন্ধ করতে ,তার কথামতো রেবা দরজায় ছিটকিনী টা তুলে দেয়।
এবার আগুন্তুক বৃহন্নলা মুখ খোলে।
সে বলতে শুরু করে এক জীবন কাব্য।
---আমি সুজন মা , তুমি হয়তো আমায় চিনতে পারনি আর কি করেই বা পারবে ,সেকী আজকের কথা।
----আমায় তুই ক্ষমা করে দে মানিক আমার ।বিশ্বাস কর আমার কোন উপায় ছিলো না।
সেদিনের পর থেকে একদিনের জন্য ও তোকে ভুলিনি।
----জানি মা ,তোমার দোষ ছিলো না ,সমাজের ভয়ে লোকলজ্জার ভয়ে বাবা তোমার কাছ থেকে আমায় প্রায়
ছিনিয়ে নিয়ে গেছিলেন।তুমি বাধা দিয়েছিলে কিন্তু বাবা ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমার দায় অস্বীকার করেছিলেন।
আচ্ছা ,তোমরা তো আগে উত্তর কলকাতায় থাকতে ,তা এখানে কবে থেকে।
-----তোমার ছোট ভাই এর জন্মের পর থেকে পুরোন সব স্মৃতি ভুলতে এখানে আসা।
----তাই ।আমি সেদিন তোমার নাতির জন্য নাচতে এসেই চিনেছিলাম।আমি চিনেছিলাম আমার মাকে।
পরিচিতি তো কম নয় আমার বাবার।নামকরা এডভোকেট ,তাই ঐ নামটা শুনেই বুঝলাম এই বাড়ির ই আমি একজন।না মা ভয় পেয়ো না ,আজ এতো বছর পরে কোন অধিকার নিয়ে আমি আসিনি।
আজ আমার জগৎ তোমাদের থেকে আলাদা মা।
শুধু ভাবো তো সেদিন কত যত্নে তুমি ঐ মাস দুয়েকের নাতিকে নীচে আনলে যতক্ষন আমরা নাচলাম
ওকে আগলে রাখলে ,আর ঠিক ঐ দু মাস বয়সেই তোমরা আমাকে তুলে দিয়েছিলে আমার জন্য নাচতে আসা
এক বৃহন্নলার হাতে ।সে শুধু তোমার ছবিটা চেয়ে নিয়ে গেছিলো আমায় মা চেনাবে বলে।
সেই থেকে ঐ ছবিটাই আমার মা।তোমাদের যেমন মা কালি ,মা দূর্গা তেমন।
------আর বলিস না, আমি সহ্য করতে পারছি না ।আমি মানছি তোর উপর অন্যায় হয়েছে ।আজ সকলে বিমল কে
আমার প্রথম সন্তান জানলেও আমার মনের আসনে তুই ,শুধু তুই ই আছিস।আমায় ক্ষমা করে দে ।
এখন যে আমার বড় আনন্দের দিন।এতদিন বঞ্চিত করে ভগবান আমায় নাতি দিয়েছেন।তুই কি চাস বল তোকে খুশী মনে সব উজার করে দেবো।
------আমি কিছু নিতে আসিনি মা ,সেদিন সকলের সামনে বলতে পারিনি তাই আজ আবার একা এলাম।বলেই তার কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট সোনালী কৌটো বের করলো আর খুলে ধরলো রেবার চোখের সামনে।
-----দেখো তো মা চিনতে পারো কি না।বিদায়ের দিন আমার হাতে এই দুটো সোনার বালাই তো পরানো ছিলো।
বহু যত্নে তুলে রেখেছিলাম।অনেক কষ্টের মধ্যেও এটা বিক্রি করিনি।
আজ এনেছি শুধু রোহন কে আশীর্বাদের জন্য।
কদিন বাদেই তো ওর অন্নপ্রাশন হবে তখন ওর হাতে পড়িয়ে দিও।শত হোক তোমরা মানো আর না মানো ওতো আমার নিজের ভাইপো।
এতদিন পর তোমরা যেমন আনন্দ করছো এটুকু করে আমায় একটু আনন্দের ভাগ নিতে দাও।
আর তো কোনকিছুর ভাগ নিতে পারছি না।
রেবা কিছু বলার আগেই কৌটো টা তার হাতে দিয়েই দরজা খুলে নেমে যায় সুজন।
******
আলোর রোশনাই, শাঁখের আওয়াজ উলুধ্বনি এসবের ভিতরেও মন টা ক়েঁদে উঠে রেবার।
সবার অলক্ষ্যে বালা জোড়া পড়িয়ে দেন রোহনের কচি হাতে।
তিনি জানেন মিত্তির বাবু যখন কথা দিয়েছেন আজ রেবার কোন কাজের কৈফিয়ত নেবেন না তাহলে তিনি
কথা রাখবেন।
মনে মনে বললেন ,রোহন তোর হাতেই রয়ে গেলো আমার কোল খালি করা সন্তানের স্মৃতি।।।।

টুটুল(শিউলি)

No comments:

Post a Comment