ঝড়ের রাত
ঝাড়বাতিটা ঘরের চাল থেকে আগের মতোই ঝুলছে শুধু সন্ধ্যে হলেই ওই হরিপদ দা আর ঘাড়ে লম্বা মতন লাঠির ডগায় আগুন এনে ওটার ভিতরে রাখা প্রতিটি বাতিতে আলো দিতে আসেনা।
কাঠের নড়বরে হয়ে যাওয়া আলগা হয়ে ঝুলে পড়া দরজার কপাট গুলো বাইরের থেকে আসা বাতাসের ঝাপটায় খটাস খটাস আওয়াজ তুলে এদিক ওদিক করে।
জীর্ন পুরানো বাড়িটার কড়ি বগরা গুলো এখন ও তাকিয়ে আছে নীচে পড়ে থাকা আবলুস কাঠের খাটটার দিকে।
অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভেঙে যাওয়া আয়না টা বহুকাল কারোর চেহারার প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত করেনি।
জানলার বেঁকে চুড়ে যাওয়া শিক ,বারন্দার মরচে পড়ে যাওয়া রেলিং একটা মন খারাপ করা গল্প নিয়ে ঝুঁকে আছে নীচের দিকে।
বদ্ধ অন্ধকারচ্ছন্ন ঘরগুলোতে ভ্যাপসা গন্ধের সাথে বাস করে একটা দুটো বাঁদুর আর পেঁচা।
ঝড়ের ঝাপটায় ভাঙা কপাটের এলোমেলো পাল্লা পড়ার শব্দে বাঁদুর গুলোও ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে থাকে।
এইসব সঙ্গিসাথী নিয়ে আরো একজন বাস করে এই বাড়ীতে , সে হলো জোনাকী।
এই বাড়ির অন্দর মহলের একটা ঘরে সে ও ভয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে জড়োসরো হয়ে কোন প্রানের সংস্পর্শের আশায়।
এখানে কি বা দিন ,কি বা রাতের পরিবেশ।
বাড়িটার ক্রমশ জড়াজীর্ন অবস্থার সাথে আস্তে আস্তে খাপ খাইয়ে নিয়েছে সে।
রোজ ই তার মনে আশা জাগে আজ হয়তো কিছু ঘটবে হয়তো এই বাড়িতে আবার আসবে প্রানের পরশ।
কিন্তু মাঝে মাঝে জোনাকীর বেশ বিরক্ত ও লাগে এভাবে আর কতদিন ই ভা সে আগলে রাখবে এই বাড়ির প্রতিটি মহল।
জোনাকী নিজেও ভাবে এক এক দিন সবাই তো এক এক করে ছেড়ে চলে গেছে
সেই বা কেন যেতে পারছে না।
তারই বা এতো আগলে থাকতে ইচ্ছা হয় কেন সব কিছু।
কোনকোন দিন দিনের বেলাতেও তো সরসর করে সাপ চলে যেতে দেখেছে সে।
রাতে তো দু চোখে ঘুম আসে না তার।
যখন একলা খুব ভয় করে জোনাকীর তখন ঐ দেয়ালে লটকানো পুরোন বাঁধানো ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
ছবির ফ্রেম গুলো উই ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে ছবির মানুষ গুলোর চেহারা হলদেটে বিবর্ন হয়ে গেছে কাউকে আর তেমন ভাবে চেনা যায় না।
তবুও জোনাকীর মনে হয় ওরা আছে ,আগের মতোই জোনাকীর পাশেই আছে।
ডাকলে এক্ষুনি সাড়া দেবে।
শুধু এই বিশ্বাসেই সব ভয় কে জয় করে এখনো পরিত্যক্ত এই বাড়িটা আগলে রেখেছে জোনাকী।
বাইরে আজ ঝড়টা সত্যিই ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
দরজার কবজাগুলো তে মরচে পড়ে এমনিতেই নড়বরে অবস্থা তার উপর আজ যে ভাবে এপাশ ওপাশ খটাস খটাস করে পড়ছে ছিটকিনি ভাঙা দরজা গুলো মনে হচ্ছে আজ রাতেই দেহ রাখবে।
ভয়ে সিঁটিয়ে একপাশে জড়োসরো হয়ে বসে আছে জোনাকী আর ছবির পরিচিত
মানুষগুলোকে আপ্রান ডেকে চলেছে যেনো আজ রাতে আসে কোন অতিথি
তার একাকীত্ব ঘোচাতে।
ঠান্ডা হিমেল বৃষ্টি ভেজা বাতাস ঘরে ঢুকে ভ্যাপসা গন্ধটা টা আরো তীব্র হয়ে নাকে
আসছে।
একটা সোঁদা সোঁদা ভেজা ভেজা স্পর্শ উঠে আসছে মাটি থেকে।
এমন সময় সত্যি সত্যি বাইরে থেকে কে যেনো ডাকছে বাড়িতে কেউ আছেন নাকি বলে ,2 পর্ব
না না ,জোনাকী কোন সারাশব্দ করছে না।
অপরিচিত অতিথিটি আস্তে আস্তে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে চলে এসেছে।
নিজের মনেই বলছে যাক ,বাবা একটা আস্তানা তো পাওয়া গেলো আজ এই
ঝড়বৃষ্টি র থেকে মাথাটা বাঁচানো যাবে।
ঘরে ঢুকে ওই লোকটি নিজের রুমাল বের করে মাথাটা মুছতে মুছতে বললো
,বৃষ্টি আসার আর দিন পেলো না, এই অজ গাঁয়ে সেই সন্ধ্যে থেকে একটা
আস্তানা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হবার জোগাড়।
তারপর সে নিজেই ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে একপাশ টা একটু ঝেড়েমুছে বসলো।
জোনাকী এতক্ষন ধরে সব খেয়াল করছিলো কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না ওর কাছে
ঘেঁষার।
লোকটি আপন মনেই গজগজ করতে লাগলো এই গ্রামে চাকরী করতে হবে এগন তাকে।
চাকরী টা যদি নেয় তাহলে অবশ্য থাকার বন্দোবস্ত স্কুল থেকেই করবে।
কিন্তু আজ যে দুরাবস্থার মধ্যে পড়লো রাত কেটে কাল বাড়ি ফিরতে পারলে হয়।
সারারাত লোকটি জেগেই বসে রইলো ,আর অপেক্ষা করতে লাগলো ঝড় বৃষ্টি
থামার।
জোনাকী ও বসে রইলো চুপ করে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে যাতে তাকে কেউ দেখতে না পায় ।
মাঝে মাঝে ছবির মানুষ গুলোর দিকে তাকাচ্ছিলো সে আর মনে মনে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছিলো পূর্বপুরুষদের কাছে।
এই জীর্ন বাড়িটায় আজ কতদিন পর একটু অন্যরকম অনুভুতি হতে লাগলো
জোনাকীর।
পরেরদিন সকালে বৃষ্টি কমে গেলো আকাশ পরিস্কার ঝলমলে হয়ে উঠলো।
কিন্তু বাড়ীর ভিতরের আবওহাওয়ার তো কোন পরিবর্তন নেই।
জোনাকী আশংকা করছিলো এই দেখে যে সকাল বেলা বৃষ্টি ধরে আসতে না আসতেই লোকটি তল্পিতল্পা গুটিয়ে রেডী হয়ে নিচ্ছিল বেড়িয়ে যাবে বলে।
সারা রাত জোনাকী ঘাপটি মেরে থাকলেও এই দিনের বেলা তার মনে হলো
লোকটা খুব খারাপ নয় খুব অসুবিধেয় পরেই কাল এই বাড়ীটায় আশ্রয়
নিতে বাধ্য হয়েছিলো।
জোনাকীর খুব ইচ্ছে করছিলো লোকটার কাছে গিয়ে বলে আজকের দিনটা থেকে যেতে তার সাথে।
আর কাল ও শুনেছে যে লোকটা এখানে চাকরী পেয়েছে।
আচ্ছা ওতো এখানেই থাকতে পারে ।
তাহলে এই জড়াজীর্ন বাড়ীটা আবার প্রান পাবে আর জোনাকী ও তার একাকীত্ব
কাটিয়ে উঠতে পারবে।
এতদিন বাদে ঐ ছবির হলদে হওয়া মানুষ গুলো জোনাকির প্রার্থনা শুনেছে।
কিন্তু একি যেই জোনাকী একটু একটু করে ধীর পায়ে লোকটার দিকে এগোতে লাগলো ওমনি লোকটার মুখটা ওমন ফ্যাকাশে মেরে যাচ্ছে কেন?
আরে আরে জোনাকীকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে লোকটা ওতো হাউমাউ করতে করতে পরি কি মরি করে ছুট লাগলো কেন?
কাল রাতভোর তো দিব্যি ছিলো ।
কি জানি বাবা
মনে মনে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাত উল্টিয়ে আবার নিজের ঘরে ঐ বাঁদুর আর পেঁচার সাথেই সময় কাটাতে চলে এলো জোনাকী।
No comments:
Post a Comment